আজকের বিশাল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি হওয়ার জন্য মেক্সিকোই দায়ী! মেক্সিকোর ভুলের কারনে অর্ধেকের বেশী জমি আমেরিকাকে দিতে বাধ্য হয়েছিল

আজকের বিশাল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তৈরি হওয়ার জন্য মেক্সিকোই দায়ী! মেক্সিকোর ভুলের কারনে অর্ধেকের বেশী জমি আমেরিকাকে দিতে বাধ্য হয়েছিল

৫০টি রাজ্য নিয়ে গঠিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকার দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ রাজ্য হচ্ছে টেক্সাস। সুইজারল্যান্ড ও ফ্রান্স দেশ দুটোর মিলিত আয়তনের থেকেও বড় টেক্সাস। ভারতের পাঁচভাগের এক ভাগ আয়তন টেক্সাসের। কিন্তু এতবড় রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও টেক্সাসের জনসংখ্যা মাত্র তিন কোটি। আমেরিকার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই টেক্সাস রাজ্য কিন্তু সর্বদা আমেরিকার ছিলনা। টেক্সাস একটা সময় মেক্সিকোর অংশ ছিল। কিন্তু অতিরিক্ত লোভের কারনে মেক্সিকোর ভুলের কারনে আজ টেক্সাস আমেরিকার অংশ। শুধু তাই নয় মেক্সিকো সরকারের ভুল নীতির জন্য আমেরিকা মেক্সিকোর বহু অঞ্চলও পেয়ে যায়। 

১৮২১ সালের আগে পর্যন্ত মেক্সিকো স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। দক্ষিন আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও মধ্য আমেরিকার বহু দেশ একটা সময় স্পেনের উপনিবেশ ছিল, এজন্য এসব দেশে এখনও স্প্যানিশ ভাষার আধিক্য রয়েছে। ১৮১০ থেকে মেক্সিকোতে স্পেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য লড়াই শুরু হয়, দীর্ঘ এগারো বছরের সংঘর্ষের পর ১৮২১ সালে মেক্সিকো স্প্যানিশ সাম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়। মেক্সিকো স্বাধীন হওয়ার সময় টেক্সাসও মেক্সিকোর অংশ হয়ে যায়। সেসময় টেক্সাসকে টেহাস বলা হত। কিন্ত মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল টেক্সাসের মতোন বিশাল রাজ্যে মাত্র ৩,৫০০ জন মেক্সিকান থাকতো, বাকী সবাই ছিল সেখানকার স্থানীয় উপজাতি বা নেটিভ আমেরিকান। মেক্সিকো সরকার চাইছিলো টেক্সাসে সাদা চামড়ার মানুষদের জনঘনত্ব বৃদ্ধি করতে। এর জন্য মেক্সিকো একটি উপায় বের করে, মেক্সিকো জানতো দক্ষিন আমেরিকার রাজ্যগুলোতে তুলোর ব্যবসা খুব ভালো হয়। এইজন্য মেক্সিকো সরকার আমেরিকানদের অনুরোধ করে যারা ভবিষ্যতে মেক্সিকোর বাসিন্দা হতে ইচ্ছুক তারা যেন টেক্সাসে এসে বসতি স্থাপন করে। এর জন্য মেক্সিকো সরকার টেক্সাসে জমির দামেও বিপুল ছাড় দেয়। ১৮২১ সালে আমেরিকাতে এক একর জমির দাম ছিল ১.২৫ ডলার, সেখানে মেক্সিকো সরকার টেক্সাসে এক একর জমির দাম নির্ধারন করে মাত্র ০.০৪ ডলার। এছাড়া মেক্সিকো এটাও জানায় কোনও পরিবারের প্রধান সর্বমোট ৪,৬০৫ একর জায়গা নিজের নামে রাখতে পারে এবং এর জন্য মোট মূল্য ছয় বছরে শোধ করতে পারবে। আমেরিকায় সেসময় একটি নিয়ম ছিল ঋন পরিশোধ করতে না পারলে সরকার জমি অধিগ্রহন করে নেবে। মাঝে মাঝে তুলোর ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বহু মানুষেরই জমি সরকার অধিগ্রহন করে নিত। তাছাড়া সেসময় আমেরিকা থেকে কোনও ব্যক্তি অপরাধ করে মেক্সিকো পালিয়ে এলে মেক্সিকো সরকার সেই ব্যক্তিকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য ছিলনা। এই দুটি কারনে আমেরিকা থেকে প্রচুর মানুষ টেক্সাসে এসে বসতি স্থাপন করে। এভাবে মেক্সিকো কিছুটা লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার দিকে এগিয়ে যায়। মেক্সিকো সরকার সেসময় বেশ কিছু লোককে নিয়োগ করেছিল যাদের কাজ ছিল আমেরিকা থেকে লোক এনে টেক্সাসে বসতি স্থাপন করানো, বিনিময়ে এদের কিছু জমি দিত মেক্সিকো সরকার। এরকমই একজন লোক মোসেস অস্টিন মেক্সিকো সরকারকে বলেছিল ৩০০ আমেরিকান পরিবারকে সে আমেরিকা থেকে টেক্সাসে আনবে কিন্তু তার আগেই তার মৃত্যু হয়। এরপর এর দায়িত্ব নেয় তার ছেলে স্টিফেন অস্টিন। কিন্তু টেক্সাসে বসতি স্থাপন করা আমেরিকানরা একটা বড় সমস্যায় পড়ে যায় তাহল ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তি। আমেরিকাতে দীর্ঘকাল ধরে ক্রীতদাস প্রথা চলে আসছিলো। ইউরোপীয়ানরা আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাস এনে আমেরিকাতে বিক্রি করতো। এই ক্রীতদাসদের দিয়ে কাজ করিয়েই আমেরিকানরা সেসময় অর্থ উপার্জন করতো। এই অমানবিক ক্রীতদাস প্রথা আমেরিকাতে বন্ধ করে আব্রাহাম লিংকন, এর জন্য তাকে নিজের জীবনও দিতে হয়। মেক্সিকো যখন স্পেনের অধীনে ছিল তখন মেক্সিকোতেও ক্রীতদাস প্রথা ছিল। কিন্তু ১৮২৪ সালে মেক্সিকো একটি নতুন সংবিধান তৈরি করে যেখানে ক্রীতদাস প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তবুও টেক্সাসে আমেরিকানরা ক্রীতদাস বিক্রি চালিয়ে যেতে থাকে। যার জন্য ১৮২৯ সালে মেক্সিকো সরকার ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে শক্ত আইন নিয়ে আসে। এই আইনকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমেরিকানরা তাদের ক্রীতদাসদের দিয়ে জোর করে একটি চুক্তিপত্রে সই করায় যেখান লেখা ছিল ওই ব্যক্তি ৯০ বছর তার মালিকের অধীনে কাজ করবে। কিন্ত তাসত্বেও মেক্সিকান সরকারের আইনে সমস্যায় পড়ে যায় আমেরিকানরা। এই সময় স্টিফেন অস্টিন মেক্সিকো সরকারকে কোনওরকমে বোঝাতে সক্ষম হয় যে সে যেসব আমেরিকানদের টেক্সাসে নিয়ে আসছে তারা যেন ক্রীতদাস রাখতে পারে। স্টিফেন অস্টিন আমেরিকা থেকে প্রায় ৯৬৬ জন পরিবারকে টেক্সাসে নিয়ে এসেছিল। মেক্সিকো সরকারের নিয়ম ছিল যে ব্যক্তি টেক্সাসে আমেরিকা থেকে একশো পরিবারকে নিয়ে আসতে পারবে তাকে ২৩,০০০ একর জমি দেওয়া হবে। এই হিসাবে স্টিফেনের কাছে তখন ১,৯৭,০০০ একর জমি ছিল। এভাবে টেক্সাসে একজন প্রভাবশালী হয়ে উঠে লছিল স্টিফেন অস্টিন। কিন্তু ধীরে ধীরে টেক্সাসে থাকা আমেরিকানদের সাথে মেক্সিকো সরকারের সমস্যা তৈরি হতে শুরু করে। টেক্সাসে থাকা আমেরিকানরা স্থানীয় মেক্সিকানদের পচ্ছন্দ করতো না। মেক্সিকো সরকার টেক্সাসে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল যে এখানকার অধিবাসীদের ক্যাথলিক হতে হবে, প্রথম দিকে আমেরিকানরা রাজি হলেও পরে তারা এর বিরোধীতা শুরু করে। এই কারনে শেষ পর্যন্ত মেক্সিকো সরকার বুঝতে পারে তারা কতটা ভুল করেছে, তারা যে উদ্দেশ্যে আমেরিকানদের টেক্সাসে এনেছিল তার বিপরীত ঘটনা ঘটছে। এই জন্য শেষ পর্যন্ত ১৮৩০ সালে মেক্সিকো আইন জারি করে জানায় আমেরিকা থেকে আর কোনও মানুষ টেক্সাসে এসে বসতি স্থাপন করতে পারবেনা। স্টিফেন অস্টিন তারপরেও গোপনে আমেরিকানদের নিয়ে আসছিলো যার কারনে তাকে জেলে ভরে দেওয়া হয়। 

মেক্সিকো সরকার টেক্সাসের বাসিন্দাদের উপর অতিরিক্ত কর বাড়িয়ে দেয়। সরকার ভেবেছিল অতিরিক্ত করের কারনে আমেরিকানরা টেক্সাস ছেড়ে চলে যাবে কিন্তু পুরো উল্টো হয়। পুরো টেক্সাস জুড়ে মেক্সিকো সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্টিফেন অস্টিন লক্ষ্য করে পুরো টেক্সাস জুড়ে রীতিমতো বিপ্লবের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই সুযোগে স্টিফেনও তাদের সাথে যোগ দেয়। টেক্সাসে স্থানীয় প্রভাবশাকী লোকেরা একটি সংগঠন তৈরি করে যার নেতা নিযুক্ত করা হয় স্টিফেনকে। টেক্সাসের লোকেদের সাথে মেক্সিকান সরকারের বারাবার লড়াই শুরু হয়। অবশেষে ১৮৩৬ সালে সান জ্যাশিনটোর লড়াইয়ে মেক্সিকোকে পরাজিত করে টেক্সাস। এভাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মাঝে স্বাধীন দেশ হিসাবে উত্থান হয় টেক্সাসের। আমেরিকা সাথে সাথেই টেক্সাসকে দখল করেনি সেসময় কারন আমেরিকা আজকের মতো সুপার পাওয়ার ছিলনা সেসময়। আমেরিকা মেক্সিকোর সাথে লড়াই এড়ানোর জন্য টেক্সাসকে তাদের অংশ করেনি সেসময়। আমেরিকা শুধুমাত্র টেক্সাসকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরেও প্রায়ই মেক্সিকো ও টেক্সাসের মধ্যে ছোট ছোট লড়াই হত, অন্যদিকে আমেরিকার সাথে মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিল টেক্সাসের। এরকম পরিস্থিতিতে টেক্সাসের মানুষজনও চাইছিলো আমেরিকার অংশ হতে। 

১৮৪৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জন টাইলার টেক্সাসকে প্রস্তাব দেয় আমেরিকার সাথে যুক্ত হওয়ার, টেক্সাস রাজি হয়ে যায়। কিন্তু মেক্সিকো আমেরিকাকে যুদ্ধের হুমকী দেয় এবং আমেরিকার সাথে মেক্সিকোর সমস্ত কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। জন টাইলার সেসময় সেনেটে টেক্সাসকে আমেরিকার সাথে যুক্ত করবার প্রস্তাব দেয় কিন্তু সেনেটে এই প্রস্তাব পাশ হয়নি সেসময়। এরপর ১৮৪৫ সালে আবারও জন টাইলার সেনেটে প্রস্তাব দেয়, তবে এবার প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। ১৮৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকারি ভাবে টেক্সাস আমেরিকার একটি রাজ্যে পরিনত হয়। এরপরে মেক্সিকো ও আমেরিকার মধ্যে বেশ কয়েকবছর ধরে যুদ্ধ চলে যাতে শেষ পর্যন্ত আমেরিকাই বিজয়ী হয়। ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমেরিকা ও মেক্সিকোর মধ্যে মেক্সিকো চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী টেক্সাস আমেরিকার অধীনেই আসে উপরন্তু মেক্সিকোকে নিজের ভূখন্ডের ৫৫ শতাংশ অঞ্চল আমেরিকাকে দিতে হয়। বর্তমান আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, নেভাদা, নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনা, উথাহ ও কলোরাডো প্রদেশ একসময় মেক্সিকোর ছিল। তবে আমেরিকা টেক্সাসের জন্য ১৫ মিলিয়ন ডলার দেয় মেক্সিকোকে এবং মেক্সিকোর কাছে টেক্সাসবাসীর ৩.৫ মিলিয়ন ডলার লোনও পরিশোধ করে আমেরিকা। এভাবে যুদ্ধের কারনে সর্বমোট ১৮.৫ মিলিয়ন ডলারে আমেরিকা টেক্সাস সহ মেক্সিকোর আরও অনেক অংশ পেয়ে যায়। এভাবে ভূল নীতির কারনে মেক্সিকো স্পেন থেকে স্বাধীনতা লাভের মাত্র ২৭ বছরের মধ্যে নিজের অর্ধেকের বেশী অঞ্চল হারিয়ে ফেলে। যদি মেক্সিকো সরকার টেক্সাসে আমেরিকানদের বসতি করতে না দিতো তাহলে মেক্সিকো আজ অনেক বড় দেশ থাকতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *