একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক নয়। দেশের পুরো ব্যাঙ্কিং ইন্ডাস্ট্রিরই মলিক। পৃথিবীর সবথেকে তিন ধনী ব্যাক্তির সমান সম্পত্তি ছিল যে ব্যাক্তির হাতে

একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক নয়। দেশের পুরো ব্যাঙ্কিং ইন্ডাস্ট্রিরই মলিক। পৃথিবীর সবথেকে তিন ধনী ব্যাক্তির সমান সম্পত্তি ছিল যে ব্যাক্তির হাতে

মানব ইতিহাসে এমন একজন ব্যক্তি ছিল যে কোনও একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক নয় বরং দেশের পুরো ব্যাঙ্কিং ইন্ডাস্ট্রিরই মলিক ছিল। এই ব্যক্তিটি সম্পূর্ন নিজের কৃতিত্বে আমেরিকাকে কয়েকবার দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচিয়েছে। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ী এই ব্যক্তির নাম ছিল জেপি মরগ্যান। এই ব্যক্তিটির কাছে এতটাই ক্ষমতা ছিল যে সে চাইলে আমেরিকার মতো দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ন ধ্বংস করে দিতে পারতো। বিশ্বের প্রথম বিলিয়ন ডলারের সংস্থা মরগ্যানই তৈরি করেছিল। উনবিংশ ও বিংশ শতকে হওয়া আমেরিকার শিল্পবিপ্লবকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল জেপি মরগ্যান। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী যেমন মার্ক জুকারবার্গ, এলন মাস্ক, টিম কুকের সমস্ত সম্পত্তি একসাথে যোগ করলেও জেপি মরগ্যানের সম্পত্তির সমতুল্য হবেনা। কিন্তু জেপি মরগ্যানকে তার আচরনের জন্য সেসময় আমেরিকান মিডিয়াতে ডেভিল বলা হত। মানুষ জন জানতো অর্থ ও ক্ষমতার জন্য মরগ্যান পারেনা এমন কিছু নেই। আমেরিকান রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট পর্যন্ত জেপি মরগ্যানকে পচ্ছন্দ করতো না। কিন্তু ১৯০৭ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে আমেরিকার দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন রুজভেল্ট পর্যন্ত বাধ্য হয় জেপি মরগ্যানের কাছে সাহায্য চাইতে। রুজভেল্ট জানতো একমাত্র মরগ্যানই আমেরিকার অর্থনীতিকে বাঁচাতে পারবে। 

জন পিয়ারপন্ট মরগ্যানের জন্ম হয়েছিল ১৮৩৭ সালে আমেরিকার কানেক্টিকাটে। তার বাবা জুনিয়াস স্পেনসার মরগ্যান আমেরিকা ও ইউরোপের একজন বড় ব্যাঙ্কার ছিল। এত ধনী পরিবারে জম্মানো সত্ত্বেও ছোট থেকেই খুব শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল মরগ্যান। তবে এসব সমস্যাই তার জীবনে আশীর্বাদ বহন করে নিয়ে আসে। খারাপ শারীরিক সমস্যার জন্য মরগ্যান বেশীরভাগ সময় বাড়িতেই অর্থনৈতিক বই পড়তেন যাতে তার বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে ধারনা হয়। ১৮৫৭ সালে পড়া শেষ করার পর বাবার সাহায্যে মরগ্যান ওয়াল স্ট্রিটে একটি ব্যাঙ্কে কাজে যোগ দেন। পরবর্তী ১৪ বছর সেখানেই কাজ করে মরগ্যান। তবে এসময় সে অর্থনীতিতে এমন কিছু কাজ করে যাতে সবাই তার উপর প্রভাবিত হয়। যেমন ১৮৫৯ সালে নিউ অরলিন্সে সফর কালে তুলোর ব্যবসা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন মরগ্যান। এই সফরে একটি ঝুঁকিপূর্ন কাজ করে মরগ্যান, কোম্পানির পয়সা দিয়ে ব্রাজিলিয়ান কফি ভর্তি একটি জাহাজ কিনে নেয় মরগ্যান। এই জাহাজ বন্দরে বহুদিন ধরেই দাঁড়িয়েছিল কেউ কিনছিলো না। মরগ্যান এই কফি বিক্রি করে মোটা অর্থ লাভ করে। কিন্তু তার এই ঝুঁকিপূর্ন কাজ তার বাবার পচ্ছন হয়নি যার জন্য মাত্র ২৪ বছর বয়সেই পরিবার ত্যাগ করে নিজের সংস্থা তৈরি করে মরগ্যান। 

১৮৬০ সালে আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ১৮৬৩ সালে আমেরিকাতে নতুন আইন করা হয় যে প্রত্যেক নাগরিককে বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতেই হবে। কিন্ত মরগ্যান ৩০০ ডলারের বিনিময়ে তার জায়গায় অন্য কাউকে সেনাবাহিনীতে পাঠায়। আসলে এই গৃহযুদ্ধে নিজের ব্যাবসায়িক লাভের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীতে যায়নি মরগ্যান। গৃহযুদ্ধের সময় মরগ্যান আমেরিকার সরকারকে ৫০০০ রাইফেল বিক্রি করে। এসব রাইফেল আগেই আমেরিকাতে ছিল কিন্তু এগুলো তেমন কার্যকর ছিলনা। মরগ্যান প্রতিটি রাইফেল পিছু  ৩.৫০ ডলার মূল্যে ৫০০০ রাইফেল কিনে সামান্য কিছু আপগ্রেড করে প্রতিটি রাইফেল পিছু  ২২ ডলার মূল্যে আমেরিকার সরকারকে বিক্রি করে দেয়। এইভাবে তার ৬০০ শতাংশ বেশী লাভ হয়। আমেরিকার সরকার পরবর্তীকালে এই খবর জানতে পেরে মরগ্যানকে যুদ্ধের সুযোগে অর্থনীতির অপব্যবহারে অভিযুক্ত করেছিল। জেপি মরগ্যান তার সম্পূর্ন জীবনকালে অর্থের জন্য এমন অনেক বিতর্কিত কাজ করেছিল। 

১৮৭১ সালে মরগ্যানের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বছর ছিল। ১৮৭১ সালে অ্যান্থনি ড্রাক্সেল নামে এক বড় ব্যাঙ্কারের সাথে যৌথভাবে ড্রাক্সেল মরগ্যান এন্ড কোম্পানি তৈরি করে মরগ্যান। এই সংস্থাই ওয়ালস্ট্রিটের রাজা করে দেয় মরগ্যানকে। এই সংস্থার এখন নাম জেপি মরগ্যান চেস এন্ড কো। মরগ্যানের তৈরি এই সংস্থা সেসময় বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন ব্যাঙ্কে পরিনত হয় যেখানে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা আসতো বিনিয়োগের জন্য এর মাধ্যমে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে মরগ্যান। সেসময় আমেরিকার অর্থনীতি খনিজ তেল, স্টিল ও বিমান বিভাগের আধিপত্য ছিল। খনিজ তেল ও স্টিল বিভাগে আগে থেকেই বড় বড় সংস্থা যুক্ত ছিল। কিন্তু মরগ্যান লক্ষ্য করে বিমান ও রেল বিভাগে কোনও বড় সংস্থা নেই, ছোট ছোট সংস্থা রয়েছে। মরগ্যান এসব সংস্থায় বিনিয়োগ করার মাধ্যমে সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নিয়ে নিত। 

১৮৭৯ সালে মরগ্যান নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলওয়ের আড়াইলাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়, এর বদলে তিনি নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল রেলওয়ের বোর্ড অফ ডিরেক্টর হন। এই ঘটনায় আমেরিকান রেলওয়ের প্রায় পূর্ন নিয়ন্ত্রন তার হাতে চলে যায়, এর পাশাপাশি তৎকালীন সময়ে আমেরিকান রেলওয়েতে সবচেয়ে বেশী ৪০ মিলিয়ন বিনিয়োগও তিনি করেন। জেপি মরগ্যানের নেতৃত্বে আমেরিকান রেলওেয়ের উন্নয়ন শুরু হয়, সেসময় আমেরিকান রেলওয়েতে বিদেশী বিনিয়োগ আসাও শুরু হয়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ রেললাইনের নিয়ন্ত্রন সরাসরি জেপি মরগ্যানের কাছে চলে যায়। থমাস আলফা এডিসনের বৈজ্ঞানিক গবেষনাতেও সেসময় তিনি অর্থায়ন করেছিললেন। ১৯০১ এর দশকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় স্টিং সংস্থা ছিল কার্নেগি। প্রতিবছর ৪০ মিলিয়ন ডলার লাভ হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানিটির মালিক কোম্পানিটি বেচতে চাইছিলেন। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মরগ্যান ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে পুরো সংস্থাটিই কিনে নেয়। আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বানিজ্যিক চুক্তি ছিল এটা। মরগ্যান এখানেই থেমে থাকেননি তিনি কার্নেগি স্টিলকে ফেডারেল স্টিল সহ অন্যান্য সংস্থার সাথে যুক্ত করে ইউএস স্টিল নামক সংস্থা তৈরি করে। ১.৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই সংস্থাটি বিশ্বের প্রথম বিলিয়ন ডলারের সংস্থা ছিল। 

১৮৯৩ সাল থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে, সেসময় আমেরিকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কও ছিলনা। আমেরিকান সরকারের কাছে মাত্র নয় মিলিয়ন ডলারের সোনার সঞ্চয় ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে জেপি মরগ্যান এগিয়ে আসে আমেরিকাকে রক্ষা করতে। তিনি আমেরিকার সমস্ত বড় বড় ব্যাঙ্কারদের সাথে নিয়ে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাথে বৈঠক করেন। বেঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আমেরিকার সোনার সঞ্চয় বাড়ানো হবে। এর জন্য মরগ্যানের নেতৃত্বে সমস্ত ব্যবসায়ীরা আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে পরবর্তী ত্রিশ বছরের জন্য ৬৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সোনার বন্ড কিনে নেয়। এর বদলে আমেরিকার সরকারকে ৩.৫ মিলিয়ন আউন্স সোনা দেওয়া হয়। মরগ্যানের এই পদক্ষেপে আমেরিকার অর্থনীতি ঠিক হয়ে যায় এবং এসমস্ত বন্ডে চড়া সুদের মাধ্যমে মোটা অর্থ মুনাফা করে মরগ্যান। এভাবে জেপি মরগ্যান আমেরিকাতে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবসায়ীতে পরিনত হয়েছিল। ১৯০১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থিওডের রুজভেল্ট মরগ্যানের সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠায়। রুজভেল্ট চাইছিলোনা কোনও ব্যাক্তি এতটা শক্তিশালী হোক যে পুরো দেশের অর্থনীতি তার নিয়ন্ত্রনে থাকবে। কিন্তু জেপি মরগ্যানকে আইনি যুদ্ধে পরাজিত করা এত সহজ ছিলনা। 

১৯০৭ সালে পুনরায় আমেরিকায় অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে বড় বড় ব্যাঙ্ক দেওলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রমে চলে যায়। বাধ্য হয়ে রুজভেল্ট মরগ্যানের সাহায্য চায়। ১৮৯০ এর দশকের মতো এবারেও আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকটে পরিত্রাতা রূপে আবির্ভাব হয় মরগ্যানের। একটি লাইব্রেরিতে মরগ্যান তার সমস্ত ধনী বন্ধু, ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। এরপর জেপি মরগ্যানের স্ট্রাটেজিতে পুনরায় আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক হয়। কিন্ত এত সবকিছু সত্ত্বেও আমেরিকানবাসীর কাছে কখনও নায়ক হতে পারেনি মরগ্যান। 

সারা জীবন লোক তার সমালোচনাই করেছে। আমেরিকান সরকার তার বিষয়ে তদন্তের জন্য একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কিন্তু তদন্ত চলাকালীনই ১৯১৩ সালের ৩১ মার্চ রোমের এক হোটেলে মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুর সময়ে জেপি মরগ্যানের মোট সম্পত্তি ছিল ৮০ মিলিয়ন ডলার যা ২০২৪ সালের হিসাবে হয় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। তবে বলা হয় তার সম্পত্তি আরও অনেক বেশী ছিল। তবে মরগ্যানের মৃত্যুর পরেও তার সাম্রাজ্যের পতন হয়নি। পরবর্তী একশো বছর মরগ্যান পরিবার পুরো আমেরিকার অর্থনীতিতে রাজত্ব করেছে। ২০০১ সালে জেপি মরগ্যান চেস নামক সংস্থা যখন তৈরি করা হয় তখন এর মোট মূল্য ছিল তিন ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক এই জেপি মরগ্যান চেস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *