ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে! আবারও কী দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তান!

ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে! আবারও কী দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তান!

ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে একটি রুটির দাম বর্তমানে ২৫ টাকা, আটা, চাল সহ বহু নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্বিগুনের থেকে বেশী হয়ে গেছে। গত রমজানে পাকিস্তানে পেঁয়াজ ৩০০ পাকিস্তানি রুপি প্রতি কেজি, টম্যাটো ২০০ রুপি প্রতি কেজি, দুধ ২১০ রুপি প্রতি লিটার ও রসুন ৬০০ রুপি প্রতি কেজিতে বিক্রি হয়েছে। পাকিস্তানে ১,৬০০ এর বেশী পোষাক তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে যার জন্য প্রায় সাত লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, এদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। আগে পাকিস্তানে ৫০০ টাকায় প্রতিদিন সংসার চালাতে পারতো সাধারন মানুষ সেখানে এখন একবেলার খাবার খরচই প্রায় ১,৫০০ টাকা হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে বহু মানুষ একবেলা খেয়ে কোনওরকমে দিন কাটাচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে বাচ্চারা স্কুল পর্যন্ত যেতে পারছেনা। গতবছর একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল পাকিস্তানে মানুষ খাবারের প্যাকেটের জন্য মারামারি করছে। পাকিস্তানের অর্থব্যবস্থা সম্পূর্ন ভেঙে পড়েছে। বিদেশী ঋনের বোঝায় জর্জরিত পাকিস্তান সরকার আরও ঋন নিতে বাধ্য হচ্ছে দেশ চালানোর জন্য। অর্থনৈতিক সংকটের কারনে পাকিস্তান তাদের একমাত্র এয়ারলাইন্স পিআইএ পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে বাধ্য হয়ে। ১৯৬০ এর দশকে এশিয়ার লিডার বলা হত পাকিস্তানকে সেই দেশটির এরকম ভয়াবহ অর্থনৈতিক দুরাবস্থা সত্যিই তাজ্জবের ব্যাপার। 

পাকিস্তানের কাছে বর্তমানে ১৪ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারের বৈদেশিক সঞ্চয় রয়েছে। আইএমএফ বা ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড পাকিস্তানকে ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক প্যাকেজ দিয়েছিল কিন্তু পাকিস্তানের জন্য এটা যথেষ্ট নয়। আরও অর্থের জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সরকারি সংস্থাগুলোকে বিক্রি করা হবে। এজন্য পাকিস্তান এয়ারলাইন্স সহ পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ন অনেক সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরন করা হচ্ছে ধাপে ধাপে। ওয়াল্ড ইকোনমিক আউটলুকের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে বেকারত্ব ৮ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে ২০২৩ সালে ২৯.৬ শতাংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হয়েছে। গতবছর মে মাসে এই পরিমান ৩৭.৯৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। পাকিস্তান স্টেট ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস অবধি পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋনের পরিমান ১৩১.৬ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের ৪০ শতাংশের বেশী শক্তির চাহিদাই আমদানি নির্ভর। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরায়েল হামাস যুদ্ধের কারনে মধ্যপ্রাচ্যে থেকে খনিজ তেল সরবরাহে সমস্যা হয় এবং তেলের দামও বৃদ্ধি পায় যার জন্য পাকিস্তানে পর্যাপ্ত শক্তির অভাবে দেশটির প্রায় চার কোটি মানুষ বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানিয়ে দিয়েছে ২০২৪ সালে পাকিস্তানের জিডিপি বৃদ্ধি হবে মাত্র ১.৮ শতাংশ। পাকিস্তানের এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের বেশ কয়েকটি বড় কারন রয়েছে। 

১) ঋনের ফাঁদ:—- পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ঋনের পাশপাশি বিশাল বিদেশী ঋনও রয়েছে। নভেম্বর, ২০২৩ সালের মধ্যে শুধু চীন থেকেই ৬৯ বিলিয়ন ডলার ঋন নিয়েছে পাকিস্তান। ১৯৫৮ সাল থেকে আইএমএফ ২৩ বার পাকিস্তানকে অর্থ দিয়েছে। পাকিস্তান তার জিডিপির তুলনায় ৭০ শতাংশের বেশী ঋন নিয়ে ফেলেছে। এই ঋন শোধ করতে পাকিস্তানকে তার লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ দিতে হচ্ছে প্রতি বছর। এপ্রিল, ২০২৩ থেকে জুন, ২০২৬ এর মধ্যে পাকিস্তানকে ৭৭.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋন শোধ করতে হবে। 

২) রাজনৈতিক অস্থিরতা :—- যেকোনও দেশের উন্নয়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে দেশটিতে একটি স্থায়ী সরকার থাকা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত দেশটিতে কোনও সরকারই তার পাঁচ বছরের কার্যকাল সম্পূর্ন করতে পারেনি। এই কারনে সঠিক কোনও আর্থিক নীতিও নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রন রয়েছে দেশের সরকারের উপর। সেনার বিরুদ্ধে গেলেই সরকারের পতন হবে। যেমন ২০২২ সালে ইমরান খানের সরকারের পতন হয় ইমরান খানকে জেলবন্দী করা হয়। এরকম রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা পাকিস্তানে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছে। 

৩) প্রাকৃতিক দুর্যোগ :—- দুর্ভাগ্যজনক হলেও পাকিস্তানে প্রতিবছর বন্যার কারনে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়। বন্যার কারনে ঘরবাড়ি, পরিকাঠামো, চাষের জমি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের বন্যায় পাকিস্তানে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। আবার নতুন করে সব নির্মান করতে ১৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। অর্থাৎ মোট ৪৬ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়। এই কারনে দেশটিতে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৪) ফিসিক্যাল ডেফিসিট ও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট:—- কোনওদেশ বার্ষিক যতটা আয় করে বাজেটে তার তুলনায় অতিরিক্ত খরচ করলে তাকে ফিসিক্যাল ডেফিসিট বা রাজস্ব ঘাটতি বলে এবং কোনওদেশ রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশী করলে তাকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট বা বর্তমান হিসাব ঘাটতি বলে। পাকিস্তানে রাজস্ব ঘাটতির পরিমান ক্রমশ বেড়েই চলেছে কারন কোনও সরকারই করের করিমান বৃদ্ধি করেনা। যে সরকারই ক্ষমতায় আসে তারাই ভোটের জন্য কর বাড়ায় না যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে দেশটির অর্থনীতিতে। পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনও সরকারই দেশটির শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তেমন ব্যায় করেনি যার জন্য পাকিস্তান রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় পন্য তৈরি করতে পারছেনা৷ কোনও দেশের রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেড়ে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় কমতে থাকে, ঠিক সেটাই হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে।

৫) শ্রম উৎপাদনশীলতা:—- ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন ডাটাবেসের তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের শ্রম উৎপাদনশীলতা ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে মাত্র ১.৩৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই একই সময়ে বাংলাদেশের শ্রম উৎপাদনশীলতা ৩.৮৮ শতাংশ, ভারতের ৪.৭২ শতাংশ এবং চীনের ৮.১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 

৬) বালুচিস্তানে সমস্যা :—- প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ন পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশে পাকিস্তান সরকারের দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মানুষদের উপর অত্যাচার ও শোষনের কারনে বালুচিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর প্রায়ই আক্রমন করা হয়। বালুচিস্তানে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে চীন পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডর বা সিপেকে চীন আর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নয়। এই সিপেককে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের অর্থনীতি পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভবনা ছিল, এখন সেটাও আর সম্ভব নয়। 

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি হওয়ার পর পরবর্তী কিছু বছর পাকিস্তানের অর্থনীতি কৃষিকাজের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। সেসময় দেশটির জিডিপির বেশীরভাগ কৃষিকাজ থেকেই পাওয়া যেত এবং ৯৯ শতাংশ রপ্তানিও কৃষিবিভাগ থেকেই হত। ১৯৫০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইকে কেন্দ্র করে বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেসময় ভারতের মতো কিছু দেশ জোট নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু জোট নিরপেক্ষ থাকলেও ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের কুটনৈতিক সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিল, এই কারনে আমেরিকা পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা করে। এখান থেকেই পাকিস্তানের অর্থনীতির পতনের সূত্রপাত শুরু হয়। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলোর দেওয়া অতিরিক্ত অর্থ পাকিস্তান ভুল জায়গায় বিনিয়োগ শুরু করে যার জন্য কৃষিবিভাগে উৎপাদন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং বানিজ্যঘাটতি বাড়তে শুরু করে। কিন্তু তবুও ১৯৬০ দশকেও পাকিস্তানের অর্থনীতি যথেষ্ট ভালো ছিল। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের কারনে পাকিস্তানে বৈদেশিক অর্থ আসার পরিমান অনেকটাই কমে যায় যার কারনে উৎপাদনও কমে যায়। কিন্তু পাকিস্তানে আরও একটি সমস্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল তা হল পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক অসামঞ্জস্য। যার কারনে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গিয়ে বাংলাদেশ নামক দেশ তৈরি হয়৷ বাংলাদেশ আলাদা হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানের জিডিপি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

১৯৭৪-১৯৭৭ সালের বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে পাকিস্তানে তুলো উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানে সেনা অভ্যুত্থান হয় যার জন্য বিদেশী সাহায্য আসাও বন্ধ হয়ে যায়। সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের জন্য একেরপর এক সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে। বিদেশ থেকে আসা অর্থের বিমিময়ে পাকিস্তান দেশে উন্নয়ন না করে সামরিক ক্ষমতা বাড়াতে থাকে এবং সন্ত্রাসীদের সহায়তা করতে থাকে। যার কারনে একটা সময় আমেরিকাও পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয় এবং পাকিস্তান এফটিএফের গ্রে লিস্টে চলে যায়। যার ফলস্বরূপ আজকের অর্থনৈতিক বিধ্বস্ত পাকিস্তান তৈরি হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *