নিউজ ডেস্কঃ ভারতবর্ষের শল্য চিকিৎসার কথা অনেক প্রাচীন কাল থেকেই শোনা যায়। ভারতের সেই সময় চিকিৎসাশাস্ত্র অনেকটাই উন্নত ছিল। আর তার একাধিক প্রমান পাওয়া গেছে অনেক সময়।
ভারতে সনাতনি চিকিৎসাবীদ সুশ্রুত প্রথম সার্জারি করে। তবে কে ছিলেন এই সুশ্রুত জানেন? সুশ্রুতের জন্ম হয়েছিল আনুমানিক ৬০০খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে। অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২৬০০+বছর আগে। তার সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানাযায় আইআইটি বারানসীতে। এখানে থাকা বহু পুস্তকে তার ব্যবহার করা বিভিন্ন টেকনিক সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বিবরণ দেওয়া রয়েছে। সুশ্রুতের টেকনিক সম্পর্কে জানতে গেলে সর্ব প্রথম পড়তে হবে “সুশ্রুতা সংহীতা”। এই বইটিতে সেই সময় এমন ধরনের সার্জারি কথা লেখা আছে যা অনেকেরই মনেই প্রশ্ন আসতে পারে যে এতো বছর আগে এতোটাই উন্নত ছিল ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্র?
সুশ্রুতের সময়ে যখন সে নিজের প্রচেষ্টায় এমন কাজ বিশেষ করে নাক প্রতিস্থাপন শুরু করলো তখন মানুষের কাছে এটা কোনো আশীর্বাদের থেকে কম ছিল না। কারণ সেই সময়ে রাজারা শাস্তি হিসাবে প্রজাদের নাক কেটে দিত। তাই সুশ্রুত তখন সমস্ত মানুষের কাছে বড় আশার মানুষ হয়ে উঠেছিল। সুশ্রুত নাক প্রতিস্থাপন থেকে শুরু করে প্লাস্টিক সার্জারি, ব্রেন সার্জারি, দাঁত তোলা, মুত্রথলি সংক্রান্ত সার্জারি, হার্নিয়া সার্জারি, শরীরের একটি অংশ কেটে বাদ দেওয়া ছাড়াও আরও একাধিক সার্জারির কাজ করতে জানতো। তার ১৮৪ পাতার সুশ্রুতা সংহীতায় ১১২০টি রোগের বিবরণ সহ, ৭০০টি ঔষধের গাছ, ৬৪টি মিনারেল্স দিয়ে ঔষধ, পশুর অঙ্গ দিয়ে ৫৭টি কার্যকরী ঔষধের বিরণ রয়েছে। হাড় ভেঙ্গে যাওয়া, হাড় প্রতিস্থাপন, ক্যটারেক সার্জারি, ব্রেইন সার্জারি এইসকল সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া আছে।
নাকের প্রতিস্থাপনের জন্য তিনি প্রথমে নাকের ক্ষতর উপর একটি পাতা রাখতেন। ক্ষতর সাইজে পাতা কেটে সেই পাতার সাইজের চামড়া গাল বা শরীরের অন্য অংশ থেকে কেটে নাকে লাগাতেন। তখন আধুনিক চিকিৎসার সরঞ্জামের কোনও প্রশ্নই ছিল না। তাই তিনি নিজের হাতে 121 টি সার্জারি টুল তৈরি করেছিলেন। যার বিবরণ তার বইয়ে লেখা রয়েছে। আর এই যন্ত্রগুলির বিশেষত্ব ছিল যে এগুলি পরিবেশের থেকে অনুপ্রাণিত। যেরকম ক্যাট বো যা বিড়ালের পাঞ্জার মত দেখতে। এই যন্ত্র আজও শরীরের চামড়া সড়িয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গে পৌছাতে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যায় ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অনেক যন্ত্রের আকার অনেক পাখির ঠোঁটের মত। বিজ্ঞান ও পরিবেশ কে একত্রিত করার যে সক্ষমতা তিনি দেখেছিলেন তা এককথায় অনন্য।
চিকিৎসাবিদ সুশ্রুত তার সার্জারি সময় রোগীর যন্ত্রণা কমাতে একটি বিশেষ আয়ুর্বেদিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতেন যা অ্যানেসথেসিয়ার মতই কাজ করত। এগুলো সুশ্রুত নিজে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে শুধু থিওরির জ্ঞান দিয়ে সার্জারি সম্ভব নয় প্র্যাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা খুব বেশি ভাবে প্রয়োজন। আর সেই কারনে তিনি বিভিন্ন ফলের খোসা কে মানুষের চামড়ার মত ব্যবহার করতেন এবং সার্জারি ট্রেনিং নিতেন এবং দিতেন। এক্ষেত্রে তিনি বেশি ব্যবহার করতেন তরমুজ। শুধু তাই নয় সেই সময় অনেক মৃত দেহকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিত মানুষ। সুশ্রুত মৃতদেহগুলি কে সংগ্রহ করে নিজের ট্রেনিংয়ের জন্য ব্যবহার করতেন।
তবে এই ধরনের কাটাছেঁড়া কে ভালোভাবে নেয়নি সমাজের অনেক উচ্চ বৃত্তের মানুষেরা, বিশেষ করে যারা মনে করত সুশ্রুত ব্রাহ্মণ সত্ত্বেও নিচু ধর্মের মানুষের শরীর নিয়ে কাটাছেঁড়া করে। এই অবস্থায় সুশ্রুত লোকালয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন মাঠের মধ্যে নিজের কর্মকাণ্ড জারি রেখেছিল। পার্সিয়ার খলিফ আল মানসুদ এই সুশ্রুতা সংহীতাকে আরবি ভাষায় অনুবাদ করেন। যার নাম হয় “কিতাব আল-সুশ্রুতা”।
এরপর ১৭৯২সালে ইংরেজরা যখন টিপুসুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ লড়েছিল যাকে আমরা যা মাইসুরের তৃতীয় যুদ্ধ নামে আমরা জানি, তখন টিপু সুলতান এক ইংরেজ বন্দির নাক কেটে দিয়েছিল। সেই সময় সুশ্রুতের এক শিষ্য সেই বন্দির মাথা থেকে চামড়া নিয়ে আবার তার নাক প্রতিস্থাপন করে দেয়। এই পুরো সার্জারি ব্রিটিশ সার্জেন্ট থমাস ক্রুজ ও জেম্স ফ্যন্লি পুরো জিনিসটা দেখে। এটা ১৭৯৪সালে “দ্যি জেন্টালম্যন্স ম্যগাজিন” তা ছাপানো হয়। তখন থেকে সারা বিশ্বে এই টেকনিক ছড়িয়ে পড়ে। আজও কত সার্জারি টেকনিক সুশ্রুতের থেকে এসেছে তা কল্পনার বাইরে।