নিউজ ডেস্কঃ ভারতবর্ষের সেনাদের কতোটা ত্যাগ এবং জেদ থাকে তা হয়ত ইতিহাস ঘাটলে ভালো করে জানা যাবে। ভারতবর্ষের রাজনীতিবিদদের কারনে একাধিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আর সেই কারনে একাধিক সময় দেশ এবং বিদেশের শত্রুরা হাত মিলিয়ে দেশের ক্ষতি করেছে একাধিক সময়ে।
সালটা ১৯৬২। ভারত চীন যুদ্ধ চলছে। চীনের আক্রমণ বাড়ছে। আর ভারতীয় সেনা বিমানবাহিনীর আক্রমণ চীনের বিরুদ্ধে শুরু হবে এই আশায় যথা সম্ভব প্রত্যুত্তর দিচ্ছে।
এই সময় বিমানবাহিনীর জন্য দৌলত বেগ ওল্ডিতে ভারতীয় সেনা তৈরি করলো একটি অত্যাধুনিক ল্যন্ডিং গ্রাউন্ড(ALG বা অ্যাডভানস ল্যান্ডিং গ্রাউন্ড)। এই ALG তৈরির কারন হল চীনের ওপর সার্ভেইল্যন্স চালানো আর তার গতিবীধির ওপর নজর রাখা। কিন্তু লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলে বায়ুর ঘনত্ব অত্যন্ত কম। পুরো বিমানবাহিনীতে একটি বিমানই আছে যার নাম প্যকেট। এই বিমানটিকে ভারতে মডিফাই করা হয়েছিল। এর দুটো ইঞ্জিনের সাথে একটি আরও ছোট অতিরিক্ত ইঞ্জিন যোগ করা হয়েছিল। তাই আদতে এটা ছিল তিন ইঞ্জিনের বিমান। কিন্তু তারপর ১৯৬৫সালে এই বিমানকে অবসর করা হয়। এর ফলে সম্পূর্ণ অব্যবহিত হয়ে পরে এই ALG। শুধু চীন নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও এই ALG এর গুরূত্ব ছিল অপরিসীম। সিয়াচেনে পাক অনুপ্রবেশ রুখতে এই ALG ভালো পজিশানে ছিল। কিন্তু এখানে অক্সিজেন অনেক কম হওয়ায় কোনো বিমানের পক্ষে এখানে ওড়া অত সোজা ছিল না। তারপর আসে ১৩ই এপ্রিল ১৯৮৪। ভারত দখল করে সিয়াচেন।
সিয়াচেনের দখলের পর লজিস্টিক সাপোর্ট পাওয়ার জন্য দৌলত বেগ ওল্ডির ALG নিজের গুরূত্বকে আরও সামনে নিয়ে আসে। ALG আরও ছিল। কিন্তু সিয়াচেনের এত কাছে কোনো ALG নেই। ততদিনে আধুনিক ইঞ্জিনের বিমান ও হেলি ভারতে চলে এসেছে। কিন্তু তৎকালিন কংগ্রেস সরকার কোনো ভাবে এটি এ্যক্টিভ করার প্রয়াস নেয়নি।
এই ALG এর উচ্চতা ছিল সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬,৬১৪ফুট। যা একে বিশ্বের সব থেকে উচু এয়ার স্ট্রিপ বানায়। এরই মধ্যে ২০০৮সালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ওয়েস্টার্ন কম্যান্ডের প্রধান হিসাবে যুক্ত হয়েছিল অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল প্রনব কুমার বারবোরা।
তার অধীনে ৬০টি এয়ারফোর্স স্টেশান ছিল। তিনি ক্ষমতায় আসার পর এক মিটিং ডাকেন। তাতে তারা এটা আলোচনা শুরু করে যে কিভাবে চীন সীমান্তে লাইন অফ এ্যক্চুয়াল কন্ট্রোল ও দৌলত বেগ ওল্ডিতে ভারতীয় সেনা ও প্যরা মিলিটারি ফোর্সকে সব থেকে দ্রুত ও বেশি লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে পারে। তারা একাধিক ALG কে চিহ্নিত করে। যেমন থৈশে, চুশুল ও ফুকচে। এগুলো এ্যক্টিভ ALG ছিল। কিন্তু কোনোটির লোকেশান ভালো ছিলনা। সেনাদের কয়েক মাইল হাটতে হবে এই ALG গুলি থেকে লজিস্টিক সাপোর্ট ফরয়োর্ড পোষ্টে নিয়ে যেতে।
এরপর এয়ার মার্শালের নজর পরে দৌলত বেগ ওল্ডির পরে থাকা ALG এর ওপর। তিনি বুঝতে পারেন এটা ঠিক সময় ঐ ALG এ্যক্টিভ করার। তিনি একাধিক ফাইল জমা করে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একে এ্যন্টনির নেতৃত্বাধীন ডিফেন্স মিনিস্ট্রির কাছে। আর প্রতিটি প্রত্যাখ্যান করা হয়। শেষে আর একটি ফাইল জমা পরলে ব্যপারটি আরও জটিল হবে বুঝতে পারে এয়ার মার্শাল। তাই তিনি এটি নিজের দায়িত্বে কাউকে না জানিয়ে এ্যক্টিভ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এই ALG এ্যক্টিভ করার চেষ্টার পিছনে আরও কিছু কারন ছিল
এটি পৃথিবীর সব থেকে উচু ALG। তাই এর গুরূত্ব ছিল খুব বেশি।
এটি কারাকোরাম পাসের খুব কাছে ছিল। তাই এটির দ্বারা যুদ্ধে খুব ভালোভাবে লজিস্টিক সাপোর্ট পেতে পারবে সেনাবাহিনী।
এয়ার মার্শাল আর্মিতে থাকা অফিসারদের সাথে আলোচনা করে। তারা সম্মতি প্রদান করে। এয়ার মার্শাল বিশ্বস্ত অফিসারদের নিয়ে একটি সার্ভে টিম গঠন করে ঐ এলাকা পরিদর্শনের জন্য এবং এই ALG তে কোনো বড় ফাটল আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়।
উত্তর আসে দ্রুত। ALG সম্পূর্ন রূপে ভালো কান্ডিশানে রয়েছে। সিলেক্ট করা হয় এএন-৩২ বিমানকে। কিন্তু ১৪০০০ফিটের এর বেশি উচ্চতায় এই বিমান নিয়ে যাওয়া খুব বিপদজনক। তাই বিমানটির ট্রায়াল শুরু হয় গোপনে। দেখা হয় বিভিন্ন প্যরামিটার্সের পরীক্ষা। ল্যন্ডিং এর থেকে টেকঅফ ছিল বেশি চ্যলেঞ্জিং। তাই ট্রায়ালে দেখা হয় টেক অফের সময় যদি একটি ইঞ্জিন বিকল হয়?, ইঞ্জিন চালু থাকা অবস্থায় যদি টায়ার পরিবর্তন করতে হয়?
সব দেখার পর ট্রায়াল শেষ হয়। তৈরি বিমান। এবার মে ৩১, ২০০৮সাল। এয়ার চিফ মার্শাল ফালি হমি মেজর ও আর্মি জেনারেল দিপক কাপুরকে একটি গল্ফ ফিল্ডে সব কথা জানায় এয়ার মার্শাল প্রনব কুমার।
শুরু হয় উড়ান। এন-৩২ কে নিয়ে পাঁচ জন উড়ে চললেন। দুইজন বিমানবাহিনীর পাইলট, একজন ন্যভিগেটর, একজন গানার ও এয়ার মার্শাল নিজে। চন্ডিগড় থেকে উড়ান শুরু হয়। আর এন-৩২ ল্যন্ড করে দৌলত বেগে সকাল ৯টায়। পুরোটাই গোপনভাবে করা হয়। সরকার জানতেও পারে নি।
এবার টেক অফের পালা সুন্দর ভাবে টেক অফও সম্পন্ন হয়। যাত্রি হিসাবে যোগ দেয় সেনার এক অফিসার। টেক অফ করা সম্পন্ম হওয়ার পরই উচ্ছাসিত সবাই। তৎক্ষণাৎ দিল্লীতে ফোন করে এয়ারমার্শাল। জানায়
“ yes, we have reactivated Daulat Beg Oldi”
এই ঘটনায় তেমন কোনো সারা পরে নি চীন ও পাকিস্তানে। কারন এন-৩২ খুব ছোট বিমান ছিল। কিন্তু এখানেই থামে নি ভারত। ২০১৩সালে সরাসরি ৪ইঞ্জিনের সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিসের ল্যন্ডিং করায় বিমানবাহিনী। ব্যস তারপর থেকেই শুরু হয় জিনপিং এর সমস্যা। তারপর সি-১৭ ও ল্যন্ড করে সেখানে। এরপর চীন বুঝতে পারে তাদের দখল করা আকসাই চীনের কাছে পৌছিয়ে গেছে ভারত। লজিস্টিক সাপোর্ট সেনাবাহিনী এবার দ্রুত পাচ্ছে। আরও মজবুত অবস্থানে ভারতীয় সেনা। এয়ার মার্শাল বুঝিয়ে দেয় এটা ১৯৬২ নয়। এখনও এই ALG এ্যক্টিভ।
আসলে আজ ভারত ও চীনের বিবাদের মূলে এই ALG রয়েছে। চীন এই ALG পূনঃ সচল হওয়াটা কোনো দিন মেনে নেয় নি। এমনকি আজ ভারতীয় বিমানবাহিনী চীনের বিরুদ্ধে যত শক্ত অবস্থান নিয়েছে আর যত সুখোই, মিগ, এ্যপাচি দেখছেন তার প্রায় সব গুলি এই ALG থেকে।
ধন্যবাদ প্রাক্তন এয়ার মার্শাল প্রনব কুমার বারবোরাকে।