বড় ভাইকে হত্যা, শাহজাহানকে গৃহবন্দী। ঔরাঙ্গজেব কিভাবে চালাকি করে মুঘল সিংহাসন দখল করেছিল?

বড় ভাইকে হত্যা, শাহজাহানকে গৃহবন্দী। ঔরাঙ্গজেব কিভাবে চালাকি করে মুঘল সিংহাসন দখল করেছিল?

উত্তর ভারতের বেশীরভাগ অংশে সতেরো এবং আঠারো শতকে মুঘলরা রাজত্ব করেছিল। এরকমই একজন মুঘল সম্রাট ছিল শাহজাহান। ১৬২৮-১৬৫৮ সাল পর্যন্ত মুঘল সম্রাট ছিল শাহজাহান। ভারতের ইতিহাসে শাহজাহান বিখ্যাত তাজমহল নির্মানের কারনে। শাহজাহানের অনেক ছেলে ছিল যার মধ্যে চারজন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ঔরাঙ্গজেব, শাহ সুজা, দারা সিখো এবং মুরাদ বখশ। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল দারা সিখো যে শাহজাহান এবং মুমতাজের ছেলে ছিল। এই মুমতাজের স্মৃতিতেই শাহজাহান তাজমহল নির্মান করেছিল। শাহজাহান তার সব ছেলেদের মধ্যে দারা সিখোকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসতো এবং শাহজাহান ঘোষনা করে দিয়েছিল দারা সিখোই তার উত্তরাধিকার হবে। 

প্রাচীনকাল থেকেই ভারত সহ সমগ্র বিশ্বে রাজপরিবারে এটাই নিয়ম ছিল রাজার বড় ছেলেই সিংহাসনে বসবে। তবে দারা সিখোকে যুবরাজ করায় বাকী রাজকুমারদের মনে ঈর্ষা জন্ম নিয়েছিল। তৎকালীন সময়ে যুবরাজ থাকার কারনে দারা সিখো বছরে দুই কোটি টাকা পেত কোষাগার থেকে। এই অর্থের বেশীরভাগই সে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে খরচ করতো। দারা সিখো ১৬৫৬ সালে অনেক হিন্দু পন্ডিতদের রাজদরবারে ডাকেন এবং উর্দু ও ফার্সি পন্ডিতদের নির্দেশ দেন হিন্দু উপনিষদ উর্দু ও ফার্সি ভাষায় লিখতে। পুরো জীবনকালে পঞ্চাশটির বেশী হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ অনুবাদ করিয়ে দারা সিখো একটি বই সিরি ই আকবর বা দি গ্রেট মিস্ট্রি তৈরি করেছিলেন। দারা সিখো মনে করতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থে মানব জীবন সম্পর্কে অসাধারন জ্ঞান রয়েছে। দারা সিখো সংস্কৃত ভাষা শেখবারও চেষ্টা করেছিলো। দারা সিখোকে শাহজাহান সবসময় নিজের কাছে রাজমহলে রাখতো।

শাহজাহানের আরেক ছেলে ঔরাঙ্গজেব বরাবরই মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনীর দায়িত্বে ছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর চেষ্টায় রত ছিল। দারা সিখো যখন রাজমহলে শিল্পকর্মে ব্যস্ত ছিল ঔরাঙ্গজেব তখন দক্ষিন ভারতের ঔরাঙ্গাবাদে মুঘল সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল। অনেক ঐতিহাসিকগন বলেন ঔরাঙ্গজেব দারা সিখোর উপর ঈর্ষা করতো কারন ঔরাঙ্গজেবের ধারনা ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের হয়ে যাবতীয় লড়াই সে করছে কিন্ত পরবর্তী সম্রাট হবে দারা সিখো। তাছাড়া তার বাবা শাহজাহান দারা সিখোর প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসাও ঔরাঙ্গজেবের দারা সিখোর উপর ঈর্ষার অন্যতম কারন ছিল। ঔরাঙ্গজেব যখন দক্ষিন ভারতে ছিল তখন পূর্ব ভারতের বাংলাতে মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্বে ছিল শাহ সুজা এবং পশ্চিম ভারতে গুজরাটের সুরাটে মুঘল সাম্রাজ্যের দায়িত্বে ছিল মুরাদ বখশ। এইসব ভাই দারা সিখোকে পচ্ছন্দ করতোনা। কিন্তু তাদের করনীয় কিছু ছিলনা কারন মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে শাহজাহান ছিল। তারা সুযোগের অপেক্ষা করছিলো কখন শাহজাহান সিংহাসন ছাড়বে এবং তারা দারা সিখোর উপর আক্রমন করবে। এই সুযোগ খুব তাড়াতাড়িই আসে। ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শাহজাহানের শরীর খারাপ হয়, এই ঘটনা প্রকাশ হতেই বাংলায় থাকা শাহ সুজা তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে এবং নিজেকে মুঘল বাদশাহ বলে ঘোষনা করে। শাহ সুজা তার পুরো সেনাবাহিনী নিয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় দারা সিখোকে আক্রমনের জন্য। সুরাটে থাকা মুরাদ বখশও তার বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে। তবে মুরাট বখশ সরাসরি আগ্রা আক্রমনে যায়নি বরং ঔরাঙ্গজেবের সাথে দারা সিখোকে সিংহাসন থেকে হটানোর পরিকল্পনা শুরু করে। শাহজাহান শাহ সুজাকে প্রতিরোধের দায়িত্ব দেয় রাজপুত রাজা জশওয়ান্ত সিংকে। জশওয়ান্ত সিং আরেক রাজপুত রাজা জয় সিংকে শাহ সুজাকে আটকানোর দায়িত্ব দেয়। উত্তরপ্রদেশের কাশীর কাছে জয় সিং ও শাহ সুজার সেনার মধ্যে লড়াই হয় যুদ্ধে শাহ সুজা পরাজিত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। এই খবর পেয়ে মুরাদ বখশ ও ঔরাঙ্গজেবও আগ্রার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আক্রমনের জন্য। ঔরাঙ্গবাদ থেকে আসা ঔরাঙ্গজেবের সেনা এবং সুরাট থেকে আসা মুরাদ বখশের সেনা মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নীর কাছে মিলিত হয়। শহাজাহান আবারও জশওয়ান্ত সিংকে দায়িত্ব দেয় মুরাদ বখশ ও ঔরাঙ্গজেবকে আটকানোর। এবার জশওয়ান্ত সিং নিজেই যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। উজ্জয়নীর কাছে পৌঁছে জশওয়ান্ত সিং প্রথমে কুটনৈতিক পদ্ধতিতে মুরাদ বখশ ও ঔরাঙ্গজেবকে বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু তারা রাজি না হওয়ায় ১৬৫৮ সালের ১৬ এপ্রিল ধারমাটের যুদ্ধ শুরু হয় উভয়পক্ষের মধ্যে। এই যুদ্ধে মুরাদ বখশ ও ঔরাঙ্গজেবের কাছে ৩০,০০০ সেনা ছিল এবং জশওয়ান্ত সিং এর পক্ষে ২২,০০০ সেনা ছিল। যুদ্ধে জশওয়ান্ত সিং পরাজিত হয়। এই যুদ্ধের পরই ঔরাঙ্গজেব আগ্রা আক্রমনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে এবং আগ্রা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দারা সিখো এই খবর পেয়ে আগ্রা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে সমুহগর ঔরাঙ্গজেব ও মুরাদ বখশকে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নেয়। দারা সিখো একটি সেনাবাহিনী গঠন করে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ঔরাঙ্গজেব ও মুরাদ বখশের কাছে যে সেনাবাহিনী ছিল তাদের বহু যুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু দারা শিখোর সেনাবাহিনীর ততটা যুদ্ধ অভিজ্ঞতা ছিলনা এবং সেনাদের মধ্যে একতাও ছিলনা। দারা সিখো সারাজীবন শিল্প, সংস্কৃতির উপরে কাজ করায় সে নিজে ঔরাঙ্গজেবের মতো কুশল যোদ্ধাও ছিলনা। 

১৬৫৮ সালের ২৯ মে দারা সিখো এবং মুরাদ বখশ ও ঔরাঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর মধ্যে সমুহগড়ের লড়াই শুরু হয়। উভয়পক্ষে সেনাবাহিনীর সংখ্যা প্রায় সমানই ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দারা সিখোর সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং দারা সিখো যুদ্ধভূমি থেকে পালিয়ে যায়। এরপর ঔরাঙ্গজেব ও আগ্রার সিংহাসনের মাঝে শুধু একজন ব্যক্তিই ছিল তার নিজের ভাই মুরাদ বখশ। কিন্তু ঔরাঙ্গজেব তার ক্ষমতা ভাগ করতে রাজী ছিলনা। যুদ্ধের পর তাঁবুতে যখন মুরাদ বখশ যুদ্ধজয়ের আনন্দে নেশা করছিলো সেসময় চালাকি করে মুরাদ বখশকে গ্রেফতার করিয়ে গোয়ালিয়রের দুর্গে বন্দী করে রাখে। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর দারা সিখো সমুহগড় থেকে পালিয়ে গিয়ে দিল্লি পালিয়ে যায়। পরে দিল্লি থেকে মুলতান হয়ে সিন্ধ এবং সিন্ধ থেকে গুজরাটে পালিয়ে যায়। গুজরাটে দারা সিখো তার এক আফগানি বন্ধু মীরজীবনের কাছে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মীরজীবন বিশ্বাসঘাতকতা করে দারা সিখোকে বন্দী করে ঔরাঙ্গজেবের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ঔরাঙ্গজেব একটি দুর্বল হাতির পিঠে পুরোনো, ফেটে যাওয়া পোষাক পড়িয়ে দারা সিখোকে বসিয়ে দিল্লির রাজপথে ঘোরায়। এরপর ঔরাঙ্গজেব দারা সিখোর উপর মুঘল সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দেবার অভিযোগ আনে এবং তাকে হত্যার আদেশ দেয়। বলা হয় ঔরাঙ্গজেব এতটাই নির্দয়ী ছিল যে দারা সিখোর কাটা মাথা একটি বাক্সে করে নিয়ে গিয়ে শাহজাহানকে দেখায় তার আদরের পুত্রের কী অবস্থা করা হয়েছে। এরপর ঔরাঙ্গজেব মুঘল সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসে এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছর মুঘল সিংহাসনে ঔরাঙ্গজেবই ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নির্দয়ী সম্রাট ছিল এই ঔরাঙ্গজেব। 

বলা হয় ১৬৫৯ সালে দারা সিখোকে হত্যার পর কোনও রীতিনীতি ছাড়াই তার মৃতদেহ হুমায়ুনের কবরস্থানের আশেপাশে কোনও অজানা জায়গায় কবর দেওয়া হয়। আজও দারা সিখোর কবর কোথায় তা জানা যায়নি। ঔরাঙ্গজেব সম্পর্কে বলা হয় সমুহগড়ের যুদ্ধে এক রাজপুত যোদ্ধা ঔরাঙ্গজেবকে হত্যা করার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হত্যা করতে ব্যার্থ হয়। সিংহাসনে বসেই শাহজাহানকে বন্দী করে ঔরাঙ্গজেব। শাহজাহান জীবনের শেষ ২০ বছর আগ্রা দুর্গে গৃহবন্দী অবস্থায় কাটায়। ঔরাঙ্গজেব ক্ষমতার এতটাই লোভী ছিল যে তার সিংহাসনে যাতে কোনও দাবী না আসে সেজন্য তার বাকী ভাইদের এবং তাদের ছেলেদেরও হত্যা করে ঔরাঙ্গজেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *